বিবস্ত্র করে পেটানো হয়েছিল আমার দেশ সম্পাদককে

সেলে ঢুকে আমাকে বিবস্ত্র করেন পাঁচ-ছয়জন আততায়ী। আমার পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার ছিল। আমাকে একটা জাম্পস্যুট পরিয়ে দুই হাত বেঁধে ফেলা হয়। আততায়ীরা আমার ওপর নির্যাতন শুরু করলে খুব দ্রুতই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
কোর্ট রিপোর্টার : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া বীভৎস নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, রাত ১টার দিকে পুরো থানার বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সেলে ঢুকে আমাকে বিবস্ত্র করেন পাঁচ-ছয়জন আততায়ী। আমার পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার ছিল। আমাকে একটা জাম্পস্যুট পরিয়ে দুই হাত বেঁধে ফেলা হয়। আততায়ীরা আমার ওপর নির্যাতন শুরু করলে খুব দ্রুতই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনার মামলার ১৫তম দিনের মতো সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ ছিল আজ (১৫ সেপ্টেম্বর)। এ মামলায় ৪৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে মাহমুদুর রহমানের জবানবন্দি রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল।
আদালতের কাঠগড়া থেকে রিমান্ডে নেওয়ার পর শুরু হয় এক ভয়াবহ যাত্রা। আয়নাঘর বা অন্ধকার সেলে চলত দমবন্ধ করা নির্যাতন। মানুষের আর্তনাদে বুক কেঁপে উঠত। হাতুড়ি, করাত আর নখ তোলার প্লায়ার্স যেন মৃত্যুর হুমকি হয়ে ঝুলত গোপন বন্দিশালার দেয়ালে। বিবস্ত্র করেও চালানো হতো নৃশংসতা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী মতের লোকদের তুলে নিয়ে আয়নাঘরে এভাবেই নির্মমতা চালাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। শেখ হাসিনার পতনের পর গত এক বছরে এমন বহু বর্ণনা উঠে এসেছে নির্যাতিতদের মুখে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দিকে শেখ হাসিনা যেভাবে ধাবিত হন, তা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ট্রাইব্যুনালের নজরে আনেন এই সম্পাদক। তিনি বলেন, দেশের জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা। তাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতনের জন্য আয়নাঘর বানিয়েছে তার সরকার। ২০১০ সালে আমি প্রথমবার গ্রেপ্তার হই। ওই সময় আমাকে র্যাব-১-এর আয়নাঘরে (যা টিএফআই সেল নামে পরিচিত) নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত থেকে রিমান্ডে নিয়ে প্রথমে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছিল। এরপর আদালতের কোনো নির্দেশ ছাড়াই আয়নাঘরে নেন তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
মাহমুদুর রহমান বলেন, আয়নাঘরে নিয়ে প্রথমে আমার চোখ বেঁধে হাতকড়া পরানো হয়। এরপর অন্ধকার সেলে নিয়ে আমাকে গারদের শিকের সঙ্গে হাতকড়া দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। টিএফআই সেলে শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি। তবে বিভিন্ন উপায়ে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিল। চোখ বাঁধা অবস্থায় আমি পাশের সেলগুলোতে কয়েদিদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের একেকজনকে সেল থেকে নিয়ে নির্যাতন করে আবার ফেলে রাখা হতো। সেখানে অধিকাংশরাই আলেম ছিলেন।
আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টর্চার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হয়তো মানসিক টর্চার করার উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণের জন্য আমার চোখ খুলে দেওয়া হয়। ওই সময় টর্চারের নানা রকম যন্ত্রপাতি দেখতে পেয়েছিলাম। এর মধ্যে ছোট ছোট হাতুড়ি, করাত ও নখ তোলার জন্য প্লায়ার্সসহ বিভিন্ন জিনিস দেয়ালে টাঙানো ছিল। এখানে আমাকে একদিন রাখা হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল ক্যান্টনমেন্ট থানায়। সেখানে রাত ১টার দিকে পুরো থানার বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সেলে ঢুকে আমাকে বিবস্ত্র করেন পাঁচ-ছয়জন আততায়ী। আমার পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার ছিল। আমাকে একটা জাম্পস্যুট পরিয়ে দুই হাত বেঁধে ফেলা হয়। আততায়ীরা আমার ওপর নির্যাতন শুরু করলে খুব দ্রুতই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
জ্ঞান ফিরলে দেখি আমাকে সেল থেকে ডিউটি অফিসারের কক্ষে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার গোটা শরীর পানিতে ভেজা ছিল। ধারণা করতে পারি আমার জ্ঞান ফেরানোর জন্য শরীরে পানি ঢালা হয়েছে। টিএফআই সেল ও ক্যান্টনমেন্ট থানার ঘটনা আমার লেখা ‘জেল থেকে জেলে’ নামের বইতে বিস্তারিত লিখেছি। বইটি ২০১২ সালের একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছিল।
মজলুম সম্পাদক বলেন, ২০১৩ সালে আমি দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার হই। ওই সময়ও আমাকে ডিবিতে রিমান্ডে নেওয়া হয়। দুই দফায় আমি ৩৯ দিন রিমান্ডে ছিলাম। দ্বিতীয় দফার রিমান্ডের সময় আমার সঙ্গে ছাত্রশিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সাক্ষাৎ হয়। এর আগে আমি দেলোয়ার হোসেনকে চিনতাম না। দুদিন আমার সঙ্গে ডিবির একই গারদে ছিলেন তিনি। সেই সময় আমি দেলোয়ারের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন দেখতে পেয়েছি।
তাকে সন্ধ্যার পর জিজ্ঞাসাবাদের নামে সেল থেকে নিয়ে যাওয়া হতো। মাঝরাতে দু-তিনজন পুলিশ তাকে বহন করে আবার গারদে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। টেনে নিয়ে আসার পর শুধু যন্ত্রণায় কাতরাতেন তিনি। কথা বলতে পারতেন না। উঠে দাঁড়ানোর কোনো শক্তি থাকতো না। দুদিন পর ডিবি কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে যে, আমার সঙ্গে দেলোয়ারকে রাখলে ভবিষ্যতে এ নির্যাতনের সব কাহিনী প্রকাশ করব। সেজন্য তাকে আমার গারদ থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের জুলুমের প্রত্যক্ষ উদাহরণ আমি ও দেলোয়ার।
মাহমুদুর রহমান বলেন, ভিন্নমত ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর জুলুমকে বৈধতা দেওয়ার জন্য দেশে ইসলামী জঙ্গিবাদের অপপ্রচার করে ফ্যাসিস্ট সরকার। জঙ্গি দমনের নামে তারা কিছুদিন পরপর বিভিন্ন নাটক তৈরি করেছে। এসব নাটকে প্রধানত গ্রামের দরিদ্র ও অসহায় জনগণের ওপর জুলুম চালানো হয়েছে। তাদের জঙ্গি সাজিয়ে ফেইক এনকাউন্টার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষকে ভুক্তভোগী বানানো হয়েছে যেন বিচার চাওয়ার কেউ না থাকে। এমন একটি উদাহরণ ঢাকার কল্যাণপুরের জাহাজবাড়ির জঙ্গি নাটক। সেখানে ডিবি থেকে কয়েকজন গুমের ভুক্তভোগীকে ধরে এনে জঙ্গি সাজিয়ে হত্যা করা হয়। এই পুরো বিষয়টি নিয়ে আমার দেশ পত্রিকায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব নাটকের মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন পুলিশের মনিরুল ইসলাম ও আসাদুজ্জামান।
এদিন বেলা ১১টা ২০ মিনিট থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়ে বিকেল পর্যন্ত চলে। তবে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ না হওয়ায় আগামীকাল মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।