অপরাধ

ভয়াল ‘মব’ পুলিশ’ও অস্থির!রুপলাল-প্রদীপকে পুলিশ বাঁচাতে পারত-

‘আমরা রূপলাল হত্যার বিচার চাই। আসামিদের দ্রুত শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে; যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সাহস না পায়।’তারাগঞ্জ পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক পাপন দত্ত বলেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে রূপলাল ও প্রদীপ লালের হত্যাকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।’

 

রংপুর প্রতিনিধি : রংপুরের তারাগঞ্জে গণপিটুনিতে জামাই-শ্বশুর নিহতের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৭০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী রোববার দুপুরে তারাগঞ্জ থানায় মামলা করেন। সোমবার সন্ধ্যায় রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে রূপলালের লাশ রেখে বিক্ষোভ করে এলাকাবাসী। গত শনিবার রাতে তারাগঞ্জের সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা এলাকায় গণপিটুনিতে রূপলাল দাস (৪০) ও প্রদীপ দাস (৩৫) নিহত হন। সম্পর্কে তাঁরা ভাগনি জামাই-শ্বশুর। পুলিশ ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল থেকে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। এরপর আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রূপলালের লাশ বাড়িতে আনার পর তা মহাসড়কের বেলতলী এলাকায় রেখে বিক্ষোভ শুরু করেন এলাকাবাসী। এতে সড়কের দুই ধারে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে।

বিক্ষোভকারীরা দ্রুত আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানান। স্থানীয় সমাজসেবক সাবু খান বলেন, ‘রূপলাল নিরপরাধ। তাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। সে বাঁচার জন্য অনেক আকুতি করেছে। তাকে পুলিশকে, সেনাবাহিনীকে দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। কেউ তাঁর কথা শোনেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই।’ঘনিরামপুর এলাকার বাসিন্দা নান্নু মিয়া বলেন, ‘আমরা রূপলাল হত্যার বিচার চাই। আসামিদের দ্রুত শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে; যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সাহস না পায়।’তারাগঞ্জ পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক পাপন দত্ত বলেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে রূপলাল ও প্রদীপ লালের হত্যাকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।’পরে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ইউএনওর আশ্বাসে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে বিক্ষোভ প্রত্যাহার করে এলাকাবাসী।

তারাগঞ্জ থানায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়, রূপলাল রবিদাস পেশায় জুতা সেলাই করতেন তারাগঞ্জ বাজারে। শনিবার রাত ৮টা ৩০ মিনিটের দিকে মিঠাপুকুরের ছরান বালুয়া এলাকা থেকে ভাতিজি জামাই প্রদীপ লালকে নিয়ে ভ্যানে করে বাড়ি ফেরার পথে সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা মোড়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি তাঁদের পথরোধ করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরই একপর্যায়ে সন্দেহভাজনেরা প্রদীপ লালের কালো ব্যাগ তল্লাশি করে ‘স্পিড ক্যানের’ বোতলে দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় এবং কিছু ওষুধ পান। বোতলের ঢাকনা খোলার পর দুর্গন্ধে বুড়িরহাট এলাকার মেহেদী হাসানসহ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়ে।

এতে উত্তেজিত হয়ে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ে মাঠে নিয়ে পাঁচ-সাত শ মানুষ লাঠিসোঁটা ও লোহার রড দিয়ে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে তাঁদের কান দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। তাঁদের তারাগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন এবং প্রদীপ লালকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির জন্য পাঠান। সেখানে প্রদীপ লাল ভোর ৪টায় মারা।

তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, ‘নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছেন। তদন্ত কার্যক্রম চলছে। কিছু আলামত পেয়েছি, সেগুলো যাছাই-বাছাই চলছে।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চোর সন্দেহে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে পিটিয়ে হত্যার সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ এসেছিল। কিন্তু ‘মবের ভয়ে’ তাঁদের উদ্ধার না করে ফিরে যায় পুলিশ। ঘণ্টাখানেক পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাঁদের অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, যাঁর মধ্যে একজন হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান; অন্যজন মারা যান কয়েক ঘণ্টা পর চিকিৎসাধীন অবস্থায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রত্যক্ষদর্শীরা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে এসব তথ্য জানান।

তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল হামিদ জানান, ‘প্রশাসন কিসের জন্য? পুলিশ আসছিল, লোকগুলাক সেফ করবে না? কিন্তু পুলিশ আসিয়া বহুত লোক দেখিয়া ঘুরি যায়। পুলিশ চাইলে লোক দুইটাক বাঁচার পারত’। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে যেখানে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তার তিন কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এর আগে আট দিনে তিনটি চুরি-ডাকাতি ও এক শিশুকে গলা কেটে হত্যা করে ভ্যান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ফলে মানুষজন চোর-ডাকাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ৩ আগস্ট থেকে চোর ধরতে এলাকাবাসী রাত জেগে পাহারা দেওয়া শুরু করেন। ঘটনাচক্রে যার নির্মম বলি হন রূপলাল ও প্রদীপ।

নিহত রূপলালের পরিবার জানায়, রূপলাল দাসের মেয়ে নুপুর রানীর বিয়ের কথাবার্তা চলছিল মিঠাপুকুরের শ্যামপুর এলাকার এক যুবকের সঙ্গে। গত রোববার বিয়ের দিন–তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এ জন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে রূপলালের ভাগনির স্বামী প্রদীপ লাল আগের দিন শনিবার ঘনিরামপুর গ্রামে রূপলালের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ কাজীরহাট এলাকায় এসে রূপলালকে ফোন করেন। সেখানে রূপলাল গিয়ে দুজন ভ্যানে চড়ে ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে রওনা হন।

রূপলালের ছেলে জয় দাস অভিযোগ করেন, শনিবার রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে কয়েকজন যুবক তাঁদের আটক করেন। একপর্যায়ে প্রদীপ লালের ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে কয়েকটি প্লাস্টিকের ছোট বোতল বের করেন তাঁরা। এটা নিয়ে তাঁদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে লোকজন জড়ো হলে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে চোর আখ্যা দেওয়া হয়। বস্তায় থাকা একটি বোতল নাকের সামনে নিয়ে মেহেদী হাসান উপস্থিত লোকজনকে বলেন, ‘এ ভাই, দয়া করে আমাকে ধরো’ বলে মাটিতে পড়ে যেতে থাকেন। এরপর দুজন তাঁকে কোলে করে সরিয়ে নেন। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে সেখানে শত শত লোক জড়ো হন। একপর্যায়ে অচেতন করে চুরি করা চোর সন্দেহে তাঁদের দুজনকে মারধর শুরু হয়। মারতে মারতে তাদের বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নেওয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রূপলাল ও প্রদীপকে যখন বুড়িরহাট মাঠে নিয়ে আসা হয়, তখন খবর পেয়ে পুলিশের দুটি ভ্যান রাত সাড়ে ৯টার দিকে বুড়িরহাট বাজারে অবস্থান নিলেও দুজনকে উদ্ধার না করে ফিরে যায়। তখনো রূপলাল ও প্রদীপ লাল জীবিত ছিলেন। এরপর প্রায় এক ঘণ্টা পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তিনটি গাড়ি সেখানে যায়। তারা বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় থেকে অচেতন অবস্থায় এ দুজনকে উদ্ধার করে।

বুড়িরহাট গ্রামের ভ্যানচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভ্যান চালে বাড়ি আসছি। তখন রাইত সাড়ে ৯টা। বুড়িরহাট বাজারের পাশোত বুড়িরহাট স্কুলের মাঠে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে জনগণ চোর সন্দেহে মারছিল। তখনো বাঁচি আছলো। দুই গাড়ি পুলিশও আলছিলো। জনগণ সরানোর জন্য পুলিশ বাসিত ফুঁকও দিছিলো। কিন্তু জনগণ না সরায় পুলিশ ঘুরি যায়। পর সেনাবাহিনী আর পুলিশের তিনটা গাড়ি আসি অজ্ঞান অবস্থায় ওই দুইজনকে নিয়া যায়।’রূপলালের মা লালচি দাস বলেন, ‘মোর বাবা তো মাটির মানুষ আছলো। কারও সাথে কোনো দিন ঝগড়া করে নাই। বিনা দোষে মোর বাবাক মারি ফেলাইছে। যায় মোর বাবাকে মারছে তার ফাঁসি চাও।’

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button